প্রেরণামূলক: স্বপ্ন থেকে বাস্তবতা

Tags



স্বপ্ন তো আমরা সবাই দেখি। শৈশবে করা চিরপরিচিত প্রশ্ন বড় হয়ে কী হতে চাই- এর জবাবে তো অনেকেই অনেক কিছু করার, অনেক কিছু হবার স্বপ্নের কথা বলতাম। পরীক্ষার খাতায় আমার জীবনের লক্ষ্য রচনায় সুন্দর করে লিখতাম নিজেদের স্বপ্ন আর লক্ষ্যের কথা। কিন্তু দিনশেষে আমাদের অধিকাংশের স্বপ্নগুলো স্বপ্নই রয়ে যায়। অথচ, এ স্বপ্নগুলো বাস্তবে রূপ দেওয়াটা কঠিন হলেও অসম্ভব নয়।

স্বপ্নকে বাস্তবতায় রূপ দেওয়ার জন্যে প্রয়োজন অধ্যবসায়, অদম্য ইচ্ছাশক্তি, চেষ্টা আর পরিশ্রম। আমাদের দেখা স্বপ্নগুলো পরিণত হবে বাস্তবতায়- তবে, এ স্বপ্নটা পূরণ করতে হলেও পোড়াতে হবে কিছু কাঠ-খড়। স্বপ্নকে বাস্তবতায় টেনে আনার একটি চমৎকার রূপকল্প আছে। যেটার শুরুটা হয় স্বপ্ন থেকেই।

স্বপ্ন:

“স্বপ্ন সেটা নয় যা তুমি ঘুমিয়ে দেখো; স্বপ্ন হলো সেটা যা তোমাকে ঘুমাতে দেয় না।”

– এ. পি. জে আব্দুল কালাম

আশা করতেই পারি যে, স্বপ্নের প্রকৃত সংজ্ঞাটা এবার বুঝতে পেরেছি আমরা। কিন্তু সমস্যাটা হলো স্বপ্ন দেখাটাই তো সব নয়। স্বপ্ন দেখা হয়ে গেলে সেটাকে সত্যি করার মিশনে নামতে হবে। আর সেই মিশনের প্রথম পদক্ষেপ হলো স্বপ্নটাকে লিখে রাখা। অবাক হওয়ার মতো হলেও এটাই আসলে স্বপ্ন পূরণের প্রথম ধাপ! অনেকেই ভাবতে পারো যে লিখে রাখার বাড়তি সুবিধাটা কোথায়? সুবিধাটা হলো, এই লিখিত স্বপ্নটাই আসলে তোমার স্বপ্ন পূরণের প্রধান রিমাইন্ডার। এবং এতে স্বপ্ন পূরণে সফল হওয়ার নিশ্চয়তাও অনেকখানি বেড়ে যায়।

লক্ষ্য:

 স্বপ্ন দেখা হয়ে গেলো, লিখে রাখাও হলো। এবার পালা লক্ষ্য নির্ধারণের। আমরা অনেকেই স্বপ্ন আর লক্ষ্যকে এক ভেবে ভুল করে বসি। কিন্তু স্বপ্ন আর লক্ষ্যের মাঝে কিছুটা তফাত রয়েছে। স্বপ্নটাকে যখন কাগজে কলমে, ডেডলাইন সহ লিখে রাখা হয় তখন সেটা লক্ষ্যে পরিণত হয়। ব্যাপারটা খোলাসা করা যাক।

ধরা যাক, আমি চাই বাংলাদেশের শিক্ষাব্যবস্থায় একটা বিশাল পরিবর্তন আনতে। এটা একটা বড় স্বপ্ন।

কিন্তু, আমি চাই ২০১৯ এর জুনের মধ্যে টেন মিনিট স্কুলের সহায়তায় প্রতিদিন একসাথে ৫,০০,০০০ শিক্ষার্থী ফ্রি-তে পড়াশোনা করবে। এটা হলো লক্ষ্য। কারণ এতে সময়সীমা নির্ধারিত।

পরিকল্পনা: 

স্বপ্ন দেখা হলো, লক্ষ্যও নির্ধারন করা হলো। এবার পালা লক্ষ্য অর্জনের জন্যে কর্মপরিকল্পনা করে ফেলা।

আমরা স্বপ্নটা নিয়েই যদি পরিকল্পনা করতে বলা হয় সেক্ষেত্রে প্রতিদিন যদি ৫,০০,০০০ শিক্ষার্থীকে শিক্ষাসেবা দিতে হয় তাহলে আমাদের আরো ভিডিও তৈরি করতে হবে। কুইজের সংখ্যা বাড়াতে হবে। প্লাটফর্মের সার্ভারটাকে সম্প্রসারিত করতে হবে। ফেসবুক, ইউটিউবে নিয়মিত কমিউনিটি ম্যানেজ করতে হবে।

এবং এই পরিকল্পনাটা যতখানি গোছানো হবে পুরো বিষয়টা ততখানি দৃশ্যমান হবে।

পরিকল্পনা মোতাবেক যখন প্রতিনিয়ত কাজ করা হবে তখনই তোমার স্বপ্ন পরিণত হবে বহু প্রতীক্ষিত বাস্তবতায়।

সবই তো হলো কিন্তু তবুও একটা “কিন্তু”-ও কিন্তু রয়েই যায় দিন শেষে। সেটা হলো স্বপ্ন পূরণের প্রথম ধাপ অর্থাৎ, স্বপ্নটাকে ডেডলাইনসহ লিখে রাখার মাধ্যমে লক্ষ্য নির্ধারণ করা; এই লিখবার কাজটাই আমরা অনেকে করি না। তারপর হতাশ হয়ে আক্ষেপের সুরে বলে বসি যে, “আমাকে দিয়ে হবে না। সম্ভব না। এ আমার কর্ম নয়।” ইত্যাদি ইত্যাদি আরো কত কী! অথচ এই আমরাই আমাদের স্বপ্নগুলোকে একটা পর্যায়ে আমাদের ধরাছোঁয়ার বাইরে পাঠিয়ে দেই। আমাদের কারণেই আমাদের স্বপ্নগুলো স্বপ্ন থেকে লক্ষ্যে পৌঁছায় না।

তুমি যদি এই পরিস্থিতিতে অবস্থান করে থাকো তাহলে তোমাকে বলছি, এখনই খুঁজে বের করো তোমার স্বপ্নটার লক্ষ্য পর্যন্ত আসার পথে প্রতিবন্ধকতা আসলে ঠিক কোথায়? তারপর সেটাকে সরানোর চেষ্টা করো, স্বপ্নটাকে লক্ষ্যে পরিণত করো।


যারা স্বপ্নটাকে লক্ষ্যে পরিণত করতে এরই মধ্যে সফল হয়েছো, কিন্তু পরিকল্পনা করতে গিয়ে হিমশিম খাচ্ছো তাদের কাজ হলো ঠিক কেন পরিকল্পনা করতে সমস্যা হচ্ছে সেটা খুঁজে বের করা। জানার চেষ্টা করা তোমার সীমাবদ্ধতা কোথায় কোথায়? তারপর সেটা নিয়ে কাজ করা এবং তারপর লক্ষ্যটাকে অর্জন করার জন্যে পরিকল্পনা করা।

পরিকল্পনা করার পর সেটা অনুযায়ী প্রতিদিন, প্রতিনিয়ত কাজ করে গেলেই স্বপ্ন বাস্তবতায় পূর্ণতা পাবে। তবে, পরিকল্পনা করা হয়ে যাবার পরের ধাপগুলোই বেশ কঠিন। কারণ, পরিকল্পনা আর বাস্তবতার মাঝে আরও কিছু বাঁধা আছে। “ভাল্লাগে না”, “টায়ার্ড”, “নট প্রোডাক্টিভ”, “কালকে করবো”…… নামের গাদাগাদা অনুভূতির প্ররোচনায় পরিকল্পনা করার পর সে অনুযায়ী প্রতিনিয়ত একইভাবে শ্রম ও সময় দেওয়াটা চালু রাখা সবার পক্ষে সম্ভব হয় না। এই বাঁধা আর প্ররোচনাকে এড়িয়ে গিয়ে প্রতিনিয়ত স্বপ্ন পূরণের লক্ষ্য অর্জনের নিমিত্তে করা পরিকল্পনা মোতাবেক কাজ করে গেলে সফলতা আসবেই। স্বপ্নগুলো সত্যি হবেই।

মনে রেখো,

“A dream written down with a date becomes a goal.

A goal breaks down with steps becomes a plan.

A plan backed by action becomes reality.”

– Greg S. Reid

তাই, আজই খুঁজে বের করো তোমার স্বপ্ন পূরণের পথে ঠিক কোন ধাপে আছো তুমি আর পরবর্তী ধাপে অগ্রসরের পথে বাঁধাটাই বা কোথায়? তারপর সেটাকে সরিয়ে দিয়ে একের একের পর এক ধাপ অতিক্রম করে তোমার স্বপ্নকে পরিণতি দাও বাস্তবতায়।

জীবনের বাস্তবতা বড়ই নিষ্ঠুর। এটাই জীবন। জীবনের বাস্তবতার বড় বৈশিষ্ট্য হচ্ছে, যতই নিষ্ঠুর হউক বা যতই কষ্ট হউক তা সয়ে নিতে হয়, মেনে নিতে হয় জীবনের প্রয়োজনেই। জীবনে কষ্ট আসলে মানসিক ভাকে যতটুকু ভেঙ্গে পড়বে জীবন তার দ্বিগুন পিছিয়ে যাবে। জীবনের সকল দূঃখ কষ্ট ও বাস্তবতাকে জীবনের অংশ হিসাবে মেনে নিয়ে স্বাভাবিক ভাবে গ্রহন করার নামই হচ্ছে সুখ।
জীবনের বৈশিষ্ট্য হচ্ছে , সে কখনও এক পথে চলেনা। মানুষের প্রত্যাশা অনুযায়ী চলেনা। জীবনের এই বৈশিষ্ট্যকে যারা মেনে নিতে পারেনা তারাই হতাশ জীবন যাপন করে। যারা মেনে নিতে পারে তারাই সুখী । কিন্তু সবাই কি পারে সব অবস্থা মেনে নিতে ? কিন্তু মেনে নিতে হয় জীবনের জন্য। জীবনের বাস্তবতা যারা মেনে নেয় তারা জীবনের আনন্দগুলো উপভোগ করে, জীবনকে উপভোগ করে। কষ্ট ও দুঃখগুলো থেকে তারা শিক্ষা নেয়। গৃহীত শিক্ষাকে কাজে লাগিয়ে তারা জীবন সাজায়। ফলে তাদের জীবনের দুঃখ কষ্টগুলো বাহির থেকে দেখা যায়না বা তারা তা দেখাতে চায়না। দুঃখ কষ্ট তারা সামলে নিয়ে সেখান থেকে শিক্ষা গ্রহন করে। তাদের সহনমাত্রা অনেক বেশী থাকায় একটা সময় এসে দুঃখ কষ্ট তাদেরকে ছুঁতে চায়না , ছুঁয় না। আমরা বলি চীরসূখী মানুষ । আসলে তা নয়। তারা দুঃখ কষ্টকে জীবনের অংশ হিসাবে স্বাভাবিক ভাবে মেনে নেয়। তারা অনেক কষ্ট সয়ে , মেনে নিয়ে কষ্টকে জয় করে নিয়েছে।

জীবনের বাস্তবতায় আসা কষ্টকে মেনে না নিয়ে হতাশ হলেই জীবন হতাশ হয়। কিছু কিছু কষ্ট জীবনে আসে যা ক্ষুদ্র জীবনের কাছে পাহাড় তুল্য। হতাশ নয়, ধৈর্য্য ও সময়ই অনেক সমস্যার সমাধান দেয়।
কষ্ট কখনও কখনও এমন ভাবে আসে যখন চোখ বন্ধ হয়ে যায়। কান বধির হয়ে যায়।কন্ঠ বোবা হয়ে যায়। বুদ্ধি নির্বোধ হয়ে যায়। শরীর পঙ্গু হয়ে যায়। দিশেহারা জীবনে সব পরিকল্পনা ছাড়খার হয়ে যায়। তারপরও মানুষকে বেঁচে থাকতে হয় জীবনের অদৃশ্য প্রয়োজনে। আমি জানিনা কী সে প্রয়োজন। জীবনের কোথায় যেন কিসের একটা অদৃশ্য টান। আমার অনুপস্থিতিতে সব চলবে যথারীতি। তারপরও মনে হয় আমিই যেন সব সমস্যা সমাধানের একমাত্র ভরষা। মনে হয়, আমি ছাড়া সমস্যা সমাধানের আর কেউ নাই। আমাকে ছাড়া ? অসম্ভব। এই মনে করে বলেই হয়তো হাজার যন্ত্রনা সয়ে বেঁচে থাকা।

জীবনের অত্যাশিত বাস্তবতা কি যে কঠিন তা বোধ হয় মানুষ মাত্রই বুঝেন।
আপনার মা আপনার এতই প্রিয় যে, এক মুহুর্ত চোখের আড়াল করেননি। কিন্ত একদিন হয়তো দেখা গেল আপনারই কোলে শুয়ে আপনার মা পৃথিবী থেকে বিদায় নিল। আপনি কি তা ভূলেও কোন দিন প্রত্যাশা করেছিলেন ? তারপরও কিন্ত স্বভাবিক ভাবে বেঁচে আছেন। থাকতে হবে , থাকতে হয়। আমার এক বন্ধুর কথা বলি। নাম অর্পি। বিবাহিত । মা হতে যাচ্ছে। স্বামী বিপ্লব চট্রগ্রামে চাকুরী করে বিধায় অর্পি এই অবস্থায় ঢাকার মিরপুরে বাবার বাসায় থাকেন। একদিন বিকালে হঠাৎ অর্পির বাবা ষ্টোক করে। হাসপাতালে ভর্তি হয়। সেদিন অর্পি কে খুব পরিশ্রম করতে হয়েছে, কারণ অর্পির কোন ভাই নাই। সাড়ে সাত মাসের গর্ভবতী অর্পি সন্ধায় অসুস্থ হয়ে পড়ে। ভর্তি হতে হয় মাতৃসদনে। ডাক্তার জানায়, জরুরী ভিত্তিতে সীজার না করলে মা ও সন্তান দুজনের জন্যই বিপদ হতে পারে। বিপ্লব কে সংবাদ দেয়া হয়। পরদিন ভোরে বিপ্লব ঢাকার উদ্দেশ্যে রওয়ানা হয়। পথিমধ্যে সংবাদ পায় অর্পির বাবা মারা গেছেন। দুপুরের পরে অর্পির সীজার হবে। বিপ্লব দিশেহারা হয়ে যায়, এখন সে কি করবে। কোথায় যাবে ? ভাইহীন অর্পির বাবার লাশ দেখতে হাসপাতালে ? নাকি নিজের স্ত্রী, সন্তানের কাছে।
বিপ্লব গাড়ী থেকে নেমে চলে যায় লাশ সামলাতে। অর্পির বাবার লাশ দেখে চিৎকার করে কাঁদতে থাকে বিপ্লব। কারণ মাত্র ১ মাস আগেই সে তার বাবাকে হারিয়েছে । নিজেকে সে অভিবাবকহীন, অসহায় ভাবছে। এক সময় তার বুকে ব্যথা উঠে এবং ঐ হাসপাতালেই ভর্তি করানো হয়। অর্পির বাবার লাশ বের করতে সময় লাগে অনেক বেশী, কারণ ভর্তির ১ ঘন্টা পর নার্স ট্রলিতে করে সামনে নিয়ে আসে বিপ্লবের লাশ।

সীজার শেষে বিকাল নাগাদ অর্পি কিছুটা সুস্থ বোধ করে। দেখে পাশে তার সন্তান নাই। জানতে পারে ,অপরিপক্ক শিশু জন্ম হওয়ায় ইনকিবিউটরে রাখা হয়েছে। সন্ধায় পর নার্স এসে জানায় “ ডাক্তাররা অনেক চেষ্টা করেছিল,,,,,, কিন্তু ,,,,, দুঃখিত,,,,”।

একই দিনে অর্পি তার তিনটি আশ্রয় হারায়। বাবা, স্বামী, সন্তান। আমাদের সমাজে নারীর বেঁচে থাকার এই তিনটিই স্থান। অর্পি বেঁচে আছে। থাকবে। বাহির থেকে কেউ কি বুঝবে এই বেঁচে থাকার ভিতরকার রূপটি কেমন।

আমি জানিনা অর্পি কেমন করে বেঁচে আছে। কেন , কিসের আশায় বেঁেচে আছে। তবু তাকে বেঁচে থাকতে হবে কষ্টের স্মৃতি নিয়ে। প্রতি বছর একই দিনে অর্পি তিনটি কবর জিয়ারত করে যে কবরে প্রতিটি বাসিন্দা তার এক একটা আত্মা।
অর্পি বেঁচে আছে,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,
এটাই হচ্ছে জীবন ও বাস্তবতা।

বাস্তবতা অনেক কঠিন, জীবন ও বাস্তবতা, জীবন বড় কঠিন, স্বপ্ন এবং বাস্তবতা, জীবন এবং বাস্তবতা, বাস্তবতার ছবি


EmoticonEmoticon