Youtube : ইউটিউব অ্যালগরিদম (Youtube Algorithm) কিভাবে কাজ করে বিস্তারিত

Tags

ইউটিউবে প্রতিদিনই কোটি কোটি বার ভিজিট করা হয় এবং সেখানে কোটি কোটি ঘন্টার ভিডিও রয়েছে। আর এত হেভি লোডের পরেও আপনি যখনই ইউটিউব ভিজিট করতে যান তখন কিন্তু লোড নেওয়ার সময় কোনো দেরি করে না এবং একই সাথে ইউটিউবে আপনি ব্যক্তিগত কি ধরণের ভিডিও দেখতে পছন্দ করেন সেটাও কিন্তু অটোমেটিক্যালি সাজেস্ট করা হয়ে থাকে। এরজন্য ইউটিউবে ব্যবহার করা হয় একটি অ্যালগরিদম। তো এই ইউটিউব অ্যালগরিদম কিভাবে কাজ করে?

এ প্রশ্নের সহজ উত্তর হচ্ছে, কেউই বিস্তারিত ভাবে জানে না ইউটিউব অ্যালগরিদম কিভাবে কাজ করে, এমনকি ইউটিউবও না। কারণ ইউটিউবের অ্যালগরিদমটি আমাদেরকে ভিডিও সাজেস্ট করার জন্য Machine learning টেকনোলজি ব্যবহার করে থাকে; মানে হচ্ছে এখানে কি কি নিয়মে ভিডিও সাজেস্ট করা হয় সেটার কোনো নির্ধারিত নিয়ম সেট করা নেই। আর অন্যদিকে গুগলও আমাদেরকে এই অ্যালগরিদম সম্পর্কে বলবে না; কারণ এতে করে বিভিন্ন টেক মানুষরা সেই অ্যালগরিদম নিয়ে গবেষণা করা শুরু করে দিবে এবং এতে অবশ্যই গুগলের সমস্যা হবে! এটা অনেকটাই কোকাকোলা তৈরির রেসিপির বা KFC এর চিকেন তৈরির রেসিপির মতোই। এই রেসিপিগুলো পাবলিকে আউট করা হয় না বিধায়ই কোম্পানিটিগুলোর পণ্য এতটা জনপ্রিয়!

মেশিন লার্নিং

যেহেতু গুগল আমাদেরকে ইউটিউবের অ্যালগরিদম নিয়ে কিছুই বলবে না আর আমরা ইতিমধ্যে জানি যে ইউটিউবের অ্যালগরিদম মেশিন লার্নিং পদ্ধতি ব্যবহার করে; তাই মেশিন লার্নিং নিয়ে কিছু বললে আপনারা বুঝতে পারবেন কিভাবে ইউটিউব অ্যালগরিদম কাজ করে। Machine Learning কে কিন্তু আমরা সহজভাষায় AI বলে আখ্যায়িত করে থাকি। আপনি যখন কোনো মেশিল লার্নিং মডেলকে কোনো কিছুর ব্যাপারে শিখাতে যাবেন তখন একে বিষয়টির উপর কয়েকটি ইনপুট প্রদান করবেন এবং সেই ইনপুটের উপর ভিক্তি করে কতগুলো “সম্ভাব্য” আউটপুট সেট করে দিবেন। এবার মেশিন লার্নিং মডেলটি আপনার ইনপুটের উপর গবেষণা করে কাজ করা শুরু করে দিবে। যেমন একটি আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্স কে আপনি বিড়াল এবং কুকুরের ছবির মধ্যে পার্থক্য ধরার জন্য ট্রেইন করছেন।

এখানে AI কে আপনি অনেকগুলো কুকুর এবং বিড়ালের ছবি ধরিয়ে দিলেন এবং তাকে বললেন সঠিকভাবে এদের মধ্য থেকে কুকুর ও বিড়ালের ছবিগুলোকে আলাদা করতে। এবার AI এর স্কোরের দিকে লক্ষ্য করে এর রেজাল্টটা দেখবেন। প্রথমবার হয়তো ৪০% সঠিক উত্তর দিতে পারবে। কিন্তু পরবর্তীতে টেস্ট করলে দেখবেন যে AI ৫০% কিংবা ৭০% সঠিক উত্তর দিতে পারবে। মানে হচ্ছে প্রতিবার বেশি পরিমাণের সঠিক উত্তর দিতে পারার সাথে সাথেই AI বেশি “অভিজ্ঞতা” লাভ করে থাকে। এখানে একটি ফর্মুলা ব্যবহার করা হয়েছে যা হলো একটি ইনপুট ছবির কতটুকু অংশ হচ্ছে বিড়ালের ছবি। এই ফর্মূলাটি সঠিক ভাবে কাজে লাগাতে পারলেই একটি মেশিন যেকোনো ছবি থেকে বিড়ালের ছবিকে আলাদা ভাবে চিহ্নিত করতে পারবে।

আর ইউটিউবের অ্যালগরিদমের জন্য এই ধরণেরই একটি মূল ফর্মূলা ব্যবহার করা হয়। যা হলো Watch time! মানে ইউটিউব ব্যবহারকারীরা কতক্ষণ একটি ভিডিওতে থাকেন সেটা। ধরুণ আপনি একটি ইউটিউব ভিডিওতে প্রবেশ করলে কিন্তু ভিডিওটি ভালো লাগলো না, স্কিপ করে গেলেন, পরবর্তী ৪/৫টি ভিডিওকেও আপনি স্কিপ করে গেলেন কিন্তু ৬নং ভিডিওটি আপনার পছন্দ হলো এবং আপনি সেটা দেখতে থাকলেন। এবার ইউটিউব অ্যালগরিদমটি এই Watch Time ফর্মূলাটির মাধ্যমে আপনাকে পরবর্তীতে এই ৬ষ্ঠ ভিডিওটির মতোই অনান্য ভিডিওকে দেখার জন্য আপনাকে সাজেস্ট করবে। যাতে করে আপনাকে পরবর্তীতে বেশি পরিমাণে ভিডিও স্কিপিং না করতে হয়।

তবে ইউটিউবের অ্যালগরিদমটি “how long have you watched a video” শুধুমাত্র এই একটি ফর্মূলার উপরই ভিক্তি করে বসে থাকে না। এটা ছাড়াও অ্যালগরিদমটি বিভিন্ন ফ্যাক্টরের উপর নির্ভর করে যেমন ভিডিওটিতে সাবস্ক্রাইবার থেকে ভিউ কত আসলো, ভিডিওটির এডগুলোকে কতগুলো ক্লিক হলো, কতগুলো লাইক বা ডিসলাইক হলো ইত্যাদি অনেকগুলো ফ্যাক্টরকে সঠিকভাবে Ranking করেই ইউটিউব অ্যালগরিদমটি কাজ করে থাকে। এগুলোকে ভিক্তি করে ইউটিউব পরবর্তীতে আপনার প্রোফাইলে একজাতীয় বিভিন্ন ভিডিওকে Suggested Videos হিসেবে পিন আউট করে রাখে; যাতে আপনি সেখানে ক্লিক করেন।

ইউটিউবে ক্লিক

ইউটিউবে সাজেস্ট ভিডিও দেওয়া হয় যাতে আপনি সেখানে ক্লিক করে ভিডিওটি দেখা শুরু করেন। আর প্রতিটি ক্লিক থেকেই কিন্তু ইউটিউব টাকা আয় করে থাকে তাই ক্লিক জিনিসটিই হচ্ছে ইউটিউবের জন্য বড় একটি ফ্যাক্টর। আর ইউটিউব থেকে কোনো ইউটিউবারকে আয় করতে হলে দুটি জিনিসের উপর খেয়াল রাখতে হয় তা হলো এভারেজ ভিউ ডিউরেশন (Average view duration) এবং অপরটি হলো ক্লিকিং রেট (Click-through rate) । এই দুটি ফ্যাক্ট কত বেশি হবে একটি ইউটিউব চ্যানেলের ভিডিও গুলো ততবেশি সাজেস্ট ভিডিওতে চলে আসার সম্ভাবনা বাড়বে এবং ফলাফল স্বরূপ চ্যালেনটির ব্যাপক প্রচারণা হবে। মানে হচ্ছে ভিডিও বুষ্ট না করেই ইউটিউব নিজে থেকেই আপনার ভিডিওকে সাজেস্ট ভিডিও নিয়ে সেটাকে বিভিন্ন ভাবে ছড়িয়ে দিচ্ছে।

Average View Duration হচ্ছে চ্যানেলের ভিডিওগুলো ঠিক কতক্ষণ ধরে ইউটিউবে দেখা হয় সেটার একটি গড় হিসেব। এটা ভিডিও কনটেন্টটির উপর নির্ভর করে। ভালো কনটেন্ট হলে এটা বাড়ানো তেমন কঠিন কিছু না কিন্তু Click-through rate বিষয়টি একটু ঝামেলা এবং কঠিন জিনিস। সাজেস্টেড ভিডিও থেকে কতগুলো মানুষ ক্লিক করে আপনার ভিডিওটি চালু করেছে সেটারই পরিসংখ্যান হচ্ছে এই Click-through rate । ক্লিক রেট বৃদ্ধি করার জন্য ইউটিউবাররা তাদের ভিডিওতে একটি চালাকি করে থাকে তা হচ্ছে Click Bait ।



আকর্ষণীয় থাম্বনেইল, আকষর্ণীয় টাইটেল এবং তেলমসলা মিশিয়ে থাম্বনেইল আর টাইটেল বানিয়েই তারা এই ক্লিক বেইট বানিয়ে থাকে। আবার অনেকেই বিভিন্ন পদ্ধতি ব্যবহার করে ইউটিউবের এই অ্যালগরিদমকে ট্যাকেল করে থাকেন। নিচে দুটি চ্যানেলের মাধ্যমে আমি আপনাকে সেটা বুঝাচ্ছি:

কেইস স্টাডি ১:

ইউটিউব
আমাদের প্রথম কেইস স্টাডিটি হচ্ছে Primitive Technology চ্যানেলকে নিয়ে। এই চ্যানেলটিতে প্রতি মাসে মাত্র একটি করে ভিডিও আপলোড করা হয়। আর ভিডিওগুলোতে দেখানো হয় কিভাবে একটি মানুষ জঙ্গলে জঙ্গলে ঘুরে ঘুরে কোনো টুলস বা যন্ত্রপাতি ছাড়াই বিভিন্ন জিনিস বানিয়ে থাকে। এই চ্যানেলের ভিডিওগুলোকে কোনো প্রকার ন্যারেশন (narration) নেই এবং তারপরেও আর্শ্চয্যমূলক ব্যাপার হচ্ছে চ্যানেলের সাবস্ক্রাইবারের সংখ্যা ৮.৭ মিলিয়ন!  এখানে তিনি দুটি জিনিস ফলো করেন।
একটি হলো তিনি প্রতি মাসে মাত্র একটি করে ভিডিও আপলোড করেন। এখানে ব্যাপারটি হলো যে তার সাবস্ক্রাইবাররা মুখিয়ে থাকেন কখন তার নতুন ভিডিওটি আসবে এবং তারা মনে করেন যে নতুন ভিডিওতে আগের থেকে বেশ নতুন কিছু দেওয়া থাকবে মানে তার চ্যানেলে ভালোই Viewer engagement রয়েছে। আরেকটি ব্যাপার হলো এই চ্যানেলের এভারেজ ভিউ ডিউরেশনটি অনেক উচ্চ লেভেলের। চ্যানেলের আপলোড করা প্রতিটি ভিডিওতেই গড়ে ৫ মিলিয়নের বেশি ভিউ হয়ে থাকে। তাই এই চ্যানেলটির ভিডিওগুলো মাঝেমধ্যেই আপনি Suggested Videos য়ে পেতে পারেন যদিও আপনি এই জাতীয় ভিডিও পছন্দ নাও করে থাকেন।

কেইস স্টাডি ২:

ইউটিউব
এবার কথা বলবো BCC Trolling চ্যানেলটিকে নিয়ে। উপরের Primitive Technology চ্যানেলটি স্বাভাবিক নিয়ম ফলো করলেও এই BCC চ্যানেলটি অনেকটাই “চোরাই” পদ্ধতি ব্যবহার করে। চ্যানেলটির ভিডিওগুলো Fortnite গেমটির ফানি ভিডিও নিয়ে করা হয়ে থাকে। বিভিন্ন জনপ্রিয় স্ট্রিমারদের ভিডিও থেকে মজার অংশগুলো কাট পেস্ট করে একটি ভিডিওতে ঠাসিয়ে দিতে তারা প্রতিদিন ভিডিও বানিয়ে থাকে। তাদের ভিডিওর টাইটেলগুলো বেশ মসলা মাখিয়ে করা হয়, যেমন প্রতিটি ভিডিও শুরু টাইটেলে *new*, *never*, *new trick*, *100 players*, *epic*, *leaked* ইত্যাদি শব্দগুলো দেওয়া থাকে যাতে টাইটেলটি আকর্ষণীয় মনে হয়।
চ্যানেলটি গতবছর ইউটিউবের অ্যালগরিদমের কাজের ধরণকে ভালো মতো করে বুঝে ফেলে আর তাই সে অনুযায়ী “চোরাই” পদ্ধতিতে চ্যানেলটি ১ বছরেই প্রায় ৭ মিলিয়নের বেশি সাবক্রাইবার কামিয়ে নেয়। Watch Time বৃদ্ধি করার জন্য তারা তাদের টাইটেল ক্লিপ কে প্রতিটি ভিডিওর মাঝখানে দিয়ে দেয় যাতে ভিউয়াররা পরবর্তীতে একপ্রকার “বাধ্য” হয়েই সেখানে ক্লিক করতে বা দেখতে হয়। এই চোরাই পদ্ধতির জন্যই চ্যানেলটির watch time বেশি উচ্চ পর্যায়ের।

চোরাই পদ্ধতি বলছি এ কারণে যে তাদের ভিডিওগুলোর টাইটেল বেশ রংচটা এবং ভিডিও থাম্বনেইলগুলোও কাস্টম ভাবে তৈরি করা হয়, আর তাই গেমার ভিউয়ার কিংবা সাধারণ ভিউয়াররা টাইটেল এবং থাম্বনেইল ইমেজ থেকে আর্কষিত হয়ে থাকে।
এই চ্যানেল থেকে কি শিক্ষা পাওয়া যায়? এই চ্যানেল আমাদের শিক্ষা দেয় য়ে Clickbait পদ্ধতি অনুসরণ করলেও সেটা সঠিকভাবে এবং মার্জিত ভাবে করা উচিত। ভিডিওর বিষয়বস্তুর থেকে অন্যরকম টাইটেল দিলে এবং থাম্বনেইল ইমেজকেও অন্য টপিকে বানালে অনেক সময় ফলাফল উল্টো হতে পারে, ভিউয়াররা রেগে গিয়ে চ্যানেলের বিরুদ্ধে রিপোর্ট দিতে পারে এবং এজন্য অনেক সময় ইউটিউব চ্যানেলের ভিডিওকে ডিলেট করে দেয় এবং বেশি রির্পোট আসলে পুরো চ্যানেলটিকেই বন্ধ করে দেয়।

তো আজ আপনারা জানতে পারলেন যে সাধারণত কি কি পদ্ধতি অনুসরণ করে ইউটিউব অ্যালগরিদম কাজ করে থাকে। ভূল করে কিংবা শখের বসে আপনি একটি রেসলিং ভিডিওকে ক্লিক করলেন এবং কিছুক্ষণ ভিডিওটি দেখে সেটা বন্ধ করে দিলেন। পরবর্তীতে ইউটিউব হোম পেজে গেলেই আপনি Suggested ভিডিওগুলোতে দেখবেন কয়েকটি রেসলিং জাতীয় ভিডিও চলে আসবে। এগুলো সবই ইউটিউব অ্যালগরিদমের খেলা! কিন্তু অনেকসময় লক্ষ্য করলে দেখবেন যে কোনো ভিডিও দেখার সময় সাইডে Recommended টাইটেলে কয়েকটি ভিডিও দেওয়া থাকে যেগুলো আপনি বর্তমানে যে ভিডিওটি দেখছেন তার টপিক থেকে আলাদা। কারণ এই ভিডিওগুলো টাকা দিয়ে Boost করা হয়েছে তাই ইউটিউব তার অ্যালগরিদমের বাইরে গিয়েও বিভিন্ন ভিডিওকে প্রমোট করে থাকে।


EmoticonEmoticon