আমার মনে হয়, আমাদের জীবনের লক্ষ্য নির্ধারণের যে ধারনাটি প্রচলিত, সেটিতে বেশ বড় ধরনের সমস্যা রয়েছে। কারন, কাওকে জীবনের লক্ষ্য নির্ধারণ করতে বললে যা ঘটে তা হল, আমি আসলে তাকে তার আশপাশের নির্ধারিত কিছু বাঁধা নিয়মের মধ্যে তাকে ফেলে প্রশ্নটি করি।
তো মানুষ এই নিয়মের মধ্যে নিজের লক্ষ্য এইভাবে তৈরি করে,
- আমাকে নিয়মিত ভালো রেজাল্ট করতে হবে যেন আমি ভালো হাই স্কুলে যেতে পারি,
- হাই স্কুলে ভালো করলে আমি ভালো কলেজে যাব।
- কলেজে ভালো রেজাল্ট করে এবং ভালো প্রস্তুতি নিয়ে আমাকে ভালো একটা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হতে হবে, এখন ধরলাম আমি একজন সফল Lawyer হবার স্বপ্ন দেখে এমন একজনের পক্ষ থেকে যদি বলি, আমাকে এমন বিশ্ববিদ্যালয়েই ভর্তি হতে হবে যেখানে আমার সার্টিফিকেটের মূল্য এবং লেখাপড়ার মান খুব উন্নত।
- বিশ্ববিদ্যালয়ে আমার CGPA ঠিক রেখে আমাকে গ্র্যাজুয়েশন শেষ করতে হবে।
- তারপর আমাকে প্র্যাকটিস করতে হবে কয়েক বছর।
- এই পদ্ধতি ঠিক থাক আমার পূর্ণ হলে আমি একজন Lawyer হিসেবে নিজেকে পরিচয় দিতে পারবো।
এভাবেই সাধারনত টিনেজাররা চিন্তা করে থাকে যে তাদের জীবনে এই স্টেপ গুলো টিক করে তাকে সামনে এগিয়ে যেতে হবে।
এখন দেখি আসলে কি হয়, Lawyer দের কথাই ধরি। ৫০ ভাগের কাছাকাছি Lawyer রা তাদের প্রফেশন নিয়ে ডিপ্রেশনে ভোগে। এটা শুধু আমাদের এইখানেই যে সমস্যা তা নয়, আমারিকা এবং অস্ট্রেলিয়াতেও জরিপ করে এই নাম্বারটা প্রায় কাছাকাছি পাওয়া যায়। তো কেন বাচ্চারা তাদের জীবনে এমন লক্ষ্য নির্ধারণ করছে, যা তারা মনে করেছিল এটাই তার জন্য সঠিক গন্তব্য, কিন্তু লক্ষ্যে পৌঁছানোর পরও তাদের একটা সময় হতাশ হতে হচ্ছে। একটা সময় মনে হতে থাকে যে, এটা না করে যদি অন্য কিছু করতাম তাহলে আমার জন্য ঠিক ছিল। এই প্রফেশন আমার জন্য না।
এটা যে শুধু Lawyer দের সাথে হচ্ছে তা নয়, অন্যান্য প্রফেশনের ক্ষেত্রেও একই সমস্যা দেখা যায়।
এই সমস্যার মূল কারন হল, জীবনের এই লক্ষ্যগুলো মন থেকে নির্ধারিত না। এই লক্ষ্যগুলো সমাজের কিছু বাঁধা ধরা নিয়মের মধ্য থেকে নির্ধারণ করা লক্ষ্য। কিন্তু এই নিয়মগুলো আমাদের জীবনে কোন খারাপ উদ্দেশ্য নিয়ে না, বরং আমাদের safety এর জন্য নির্ধারণ করা, কারন অনেক আদি যুগ থেকেই মানুষ টিকে থাকার জন্য একজন আরেকজনের লক্ষ্য রাখতো এবং নির্দিষ্ট কিছু নিয়ম সবাই পালন করত যেন বাইরে থেকে কোন অজানা আঘাত না আসে যা তাদের অস্তিত্তে আঘাত আনতে পারে। যেমন, মেয়েরা ছেলেদের থেকে শারীরিক শক্তিতে দুর্বল ছিল বলে ছেলেরা মেয়েদের সম্পূর্ণ দায়িত্ব নিত। এক একটি পরিবার কম হলেও ৪-৫টা বাচ্চা নিত কারন, চিকিৎসা ব্যাবস্থা ভালো না হওয়ায় অনেক বাচ্চাই মারা যেত, ইত্যাদি।
এখন সমস্যা হচ্ছে, আমাদের সমাজের মানুষগুলো বর্তমান পৃথিবীর সবকিছু অনেক পরিবর্তন হবার পর এখনো এই নিয়মের বাধন থেকে মুক্ত হতে চায়না। তাই আমি প্রচলিত নিয়মে জীবনের লক্ষ্য নির্ধারণের পক্ষে না কারন, এই প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে আমার সমাজের নিয়মের বাইরে চিন্তা করার সুযোগ খুবই কম।
আমার পরামর্শ হচ্ছে, জীবনের লক্ষ্য নির্ধারণ আমরা নিজেরাই করতে পারি ৩টা প্রশ্নের উত্তর দেয়ার মাধ্যমে। এবং আমার মতে জীবনের লক্ষ্য নির্ধারণে এটি হল সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ৩টি প্রশ্ন।
প্রথম প্রশ্নটি হলঃ আমার জীবনে কোন কোন অভিজ্ঞতাগুলো আমি চাই আমার সাথে হোক?
এখন আমি তোমাদের বলতে পারি কেন এটা এত গুরুত্বপূর্ণ। দুই ধরনের লক্ষ্য আছে, একটা হল Means Goal (উপায়), আরেকটা হল End Goal.
মানুষ আসলে Means Goals গুলো পূরণ করার পেছনে বেশী সময় দেয় কিন্তু তারা বুঝে না যে Means Goal এবং End Goal এর মধ্যে পার্থক্য আছে। Means Goal হল, CGPA ভালো করা, গ্রাজুয়েশন শেষ করা, নির্দিষ্ট একটা চাকরী পাওয়া, অবসরের জন্য টাকা জমানো ইত্যাদি। কিন্তু ঐ মানুষদের যদি জিজ্ঞাসা করা হয় কেন তুমি এই কাজগুলো করতে চাও? উত্তরে একটা কারন আসে। “আমি ভালো CGPA পেতে চাই কারন উচ্চতর শিক্ষার জন্য এটা আমাকে সাহায্য করবে।” এই “কারন” আমাদের End Goal এর দিকে নিয়ে যায়। End Goal হল অসাধারণ কিছু যার জন্য মানুষ পরিপূর্ণ তৃপ্তি পায়। এটা নিজের সন্তান প্রথম কোলে নেয়ার মত, প্রথম নিজের ব্যাবসা খুলে প্রথম ক্রেতাকে সার্ভিস দেয়ার মত, প্রথম বই পড়ে শেষ করার মত, নিজের তৈরি করা শিল্প নিয়ে সবাই প্রশংসা করার মত আনন্দ পাওয়া হচ্ছে End Goal.
সুশান্ত পাল: পড়া মনে রাখার ১০টি কৌশল মেনে চলুন
তাই আমি বলব জীবনের লক্ষ্য নির্ধারণের প্রশ্নের উত্তর দেয়ার ক্ষেত্রে Means Goal এর কথা ভুলে দিয়ে সরাসরি End Goal নিয়ে চিন্তা কর, তোমার জীবনে কোন অভিজ্ঞতাগুলো তুমি চাও? এখান থেকেই তুমি তোমার অভিজ্ঞতার ইচ্ছাগুলো লিখে রাখতে পারো। এবং প্রশ্নের উত্তর লিখতে গিয়ে তুমি খাতায় ৩টা ছক কেটে প্রথম ভাগে তোমার অভিজ্ঞতার ইচ্ছাগুলো লিখে ফেল।
নিজেকে জিজ্ঞাসা কর, কোন অভিজ্ঞতা তুমি মন থেকে চাও? তুমি কার সাথে থাকতে চাও? তোমার বাড়িতে কি কি চাই? কোন দেশগুলো ঘুরতে চাও? কোন জায়গাগুলোতে যেতে চাও? কোন ধরনের পরিবার তুমি চাও? মনে যতঁ অভিজ্ঞতার কথা আশে সব লিখে রাখ।
দ্বিতীয় প্রশ্নটি হলঃ এই অভিজ্ঞতা অর্জন করার জন্য আমি কিভাবে নিজেকে তৈরি করতে পারি?
আমি বিশ্বাস করি, প্রাচীনকাল থেকেই মানুষ নিজের প্রয়োজন মেটাতে যা করা লাগে এবং তার জন্য নিজেকে যেভাবে প্রস্তুত করা লাগে, তা সে করতে পারে।
তোমার মনের এই অভিজ্ঞতা অর্জন করতে তোমাকে কি শিখতে হবে? কোন বিষয়ে জ্ঞান থাকতে হবে? কোন ভাষা শিখতে হবে? কোন যোগ্যতা তোমার থাকতে হবে? ইত্যাদি। খেয়াল করে দেখবে তুমি তোমার মনের ইচ্ছা পূরণ করতে যা করতে চাও, সেটাই তোমার লক্ষ্য এবং এই লক্ষ্য অর্জনেই তুমি মন থেকে তৃপ্ত হবে। তাই সমাজের বেঁধে দেয়া নিয়মে নিজেকে যোগ্য করবেনা। নিজের ইচ্ছাগুলো পূরণে নিজেকে যোগ্য করে তোল।
এখন তোমার কাছে দুইটা তালিকা আছে। একটা তোমার যে অভিজ্ঞতাগুলো অর্জনের ইচ্ছা সেটি, আর দ্বিতীয়টা, সেই অভিজ্ঞতা অর্জনে তোমাকে যা করতে হবে। এখন তোমাকে তৃতীয় প্রশ্নের উত্তর লিখতে হবে।
তৃতীয় প্রশ্নটি হলঃ আমার অভিজ্ঞতা আর যোগ্যতার মাধ্যমে আমি পৃথিবীকে কি দিতে পারবো?
এই প্রশ্নের উত্তরটা খুব গুরুত্বপূর্ণ কারন, Dalai Lama বলেছেন, “If you want to be happy, make other people happy”.
আমি বিশ্বাস করি, তুমি যখন নিজের লক্ষ্য নির্ধারণের ক্ষেত্রে তুমি যখন এই প্রশ্নগুলোর উত্তর লিখবে, শেষ প্রশ্নের উত্তর তোমাকে পরিপূর্ণতা দিবে। তুমি যদি কোন বিষয়ে দক্ষ হতে চাও, সেই দক্ষতা অর্জনের পর আরেকজনকে শেখাও। তুমি সুন্দর মিউজিক করতে পারো, এই যোগ্যতা দিয়ে মানুষের জন্য গান বানাও যা যুগ যুগ ধরে মানুষ মনে রাখবে। তৃতীয় প্রশ্নের উত্তরে তোমার যে তালিকা তৈরি হবে সেটি তোমাকে তোমার লক্ষ্য অর্জনের পরিপূর্ণতা অনুভব করাবে।
আমি মনে করি, আমার জীবনের লক্ষ্য কি হওয়া উচিৎ সেটি আমি ছাড়া আর কেউ সঠিকভাবে বলতে পারবে না এবং সেটি সম্ভবও না। তাই এই তিনটি প্রশ্নের উত্তর নিজেকে দাও আর সিদ্ধান্ত নাও তোমার জীবনের লক্ষ্য কি হওয়া উচিৎ এবং কেন হওয়া উচিৎ।
এই পদ্ধতি অনুসরনে তোমার উপকার হয়ে থাকলে কমেন্টে জানাতে ভুলবে না।
EmoticonEmoticon