পেয়ারা-পাউরুটিতেই দিন পার
আবু সায়েমের বাড়ি কুড়িগ্রামে। বাবা অন্যের জমিতে কাজ করতেন। সে আয়ে তিনবেলা ভাত জুটত না। বাড়তি আয়ের জন্য মা কাঁথা সেলাই করতেন। তারপর সে কাঁথা বাড়ি বাড়ি বিক্রি করতেন। কত দিন কত রাত সায়েম যে না খেয়ে কাটিয়েছেন, সে হিসাব নিজেও জানেন না।
আজ সায়েমের কষ্টের দিন ঘুচেছে। ৩৫তম বিসিএসে শিক্ষা ক্যাডারে সমাজকল্যাণে মেধাতালিকায় দ্বিতীয় হয়েছেন তিনি। কথায় কথায় শৈশবের দিনে ফিরে গেলেন সায়েম, ‘আম্মা খুব ভোরে উঠে অন্য মানুষের পেয়ারাগাছের তলা থেকে বাদুড়ে খাওয়া পেয়ারা কুড়িয়ে আনতেন। ওই পেয়ারা ছিল আমাদের সকালের নাশতা।’
তাঁদের ঘরের সামনেই ছিল পেঁপেগাছ। ভাতের জোগাড় না হলে কাঁচা-পাকা পেঁপে খেয়েই থাকতে হতো। চাল না থাকায় একবার নাকি তাঁর আব্বা খেত থেকে কলাই তুলে আনেন। সেই কলাই ভাজা খেয়েই শুরু হয় তাঁর পেটজ্বলা। অসুস্থ হয়ে পড়েন। ভাগ্যগুণে সে যাত্রায় বেঁচে যান সায়েম।
এভাবে অনাহারে-অর্ধাহারে, অসুস্থতায় কাটত দিনগুলো। তবু পড়াশোনা চালিয়ে গেছেন, ছাড়েননি সায়েম। মাধ্যমিকের ভালো ফলের ধারা ধরে রাখলেন উচ্চমাধ্যমিকেও। এইচএসসি পরীক্ষার পর গ্রামের একটি কোচিং সেন্টারে ক্লাস নিয়েছেন কিছুদিন। সায়েম বলেন, ‘ক্লাস করিয়ে ২ হাজার ৩০০ টাকা পেলাম। সেই টাকাতেই ভর্তি পরীক্ষা দিলাম। ভর্তির সুযোগ পেলাম শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ে।’ ছাত্র পড়িয়ে চলল বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়া আর বেঁচে থাকার লড়াই। সে লড়াইয়ে জয়ী হলেন সায়েম। বিশ্ববিদ্যালয়ের গণ্ডি পেরিয়ে বিসিএস পরীক্ষা দিলেন।
সায়েম বললেন, বিসিএসের মৌখিক পরীক্ষায় যাওয়ার মতো ভালো কোনো পোশাক ছিল না। এক বন্ধু পাশে এসে দাঁড়ায়। চাকরি পাওয়ার আগ পর্যন্ত সায়েম কোনো দিন সকালে নাশতা করেননি। শুধু দুপুরের দিকে পাঁচ টাকা দামের পাউরুটি খেয়ে দিন পার করতেন।
সায়েম বলেন, ‘মা অন্যের কাঁথা সেলাই করে দিতেন। প্রতি কাঁথা হিসেবে মজুরি পেতেন ৭০ থেকে ১০০ টাকা। মায়ের ১০টি আঙুলে জালির মতো অজস্র ছিদ্র। আজ আমার মায়ের জীবন সার্থক।’
দিনমজুরের কাজ করতে হয়েছিল জাহিদুলকে
জাহিদুলের বাবা ট্রেনে ঘুরে ঘুরে এটা-ওটা বিক্রি করতেন। কোদাল দিয়ে কুপিয়ে মা জমি চাষ করতেন। বড় ভাই তাঁর চাচার দোকানে কাজ করতেন। সেখান থেকে প্রতি ঈদে প্রিন্টের কাপড়ের জামা বানিয়ে দিতেন। ওটাই জাহিদুলের সারা বছরের পোশাক। বিদ্যালয়ের বন্ধুরা যখন উৎসবমুখর হয়ে শিক্ষাসফরে গিয়েছে কিংবা ঈদের ছুটিতে হইহল্লায় মেতেছে, জাহিদুল তখন বাজারে ছোলা মুড়ি বিক্রি করেছেন। কখনো–বা রাত জেগে ভাইয়ের দোকানে কাজ করেছেন।
এসএসসি পরীক্ষায় এলাকার অনেকগুলো স্কুলের মধ্যে সেরা ফল করেন জাহিদুল ইসলাম। ভর্তি হলেন রাজবাড়ী সরকারি কলেজে। বড় ভাই চাল দিয়ে যেতেন। সেটাতেই মাস পার করতে হতো। ২০০৫ সালে উচ্চমাধ্যমিক পাস করলেন। কোচিং করা তো দূরের কথা, একটা বই কেনার সামর্থ্যও ছিল না।
উচ্চমাধ্যমিক পাসের পর পাংশা কলেজে স্নাতক পাস কোর্সে ভর্তি হয়ে টিউশনি শুরু করলেন। পরের বছর সেই টাকা দিয়ে ভর্তি পরীক্ষা দিলেন। কুষ্টিয়ার ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ে ব্যবস্থাপনা বিভাগে ভর্তির সুযোগ পেলেন। ঘাড়ে চাপল ফের দুশ্চিন্তা। পড়ার খরচ পাব কোথায়! একটি বেসরকারি ব্যাংক থেকে শিক্ষাঋণ নিলেন। টিউশনিও জুটল।
কষ্টের জীবনে পড়াশোনা চলল। প্রথম শ্রেণিতে বিবিএ ও এমবিএ শেষ করলেন। পড়াশোনা শেষ। কী করবেন? ভাবতে ভাবতেই গুরুতর অসুস্থ হলেন। জাহিদুল সেই সময়ের স্মৃতিচারণা করে বলেন, ‘হাঁটতে পারি না। একদিকে দেনা, অন্যদিকে আমার অসুস্থতা। হাঁটার ক্ষমতা নেই, পকেটে টাকা নেই, মানুষের মাঝে যেতে পারিনি। ঢাকায় গিয়ে চাকরির পরীক্ষা দেব। কোথায় থাকব? ৩৪তম বিসিএসে কৃষি বিপণন ক্যাডারে প্রথম স্থান পেলাম। এই ঢাকা শহরে আমি স্বাবলম্বী, বাসা ভাড়া নিয়ে থাকি—এ আমার জীবনের অনেক বড় পাওয়া।’
কাঠমিস্ত্রির সহকারী থেকে বিসিএস ক্যাডার
মনিরুল ইসলামরা সাত ভাইবোন। বাবা-মা হিমশিম খান খাবার জোটাতে। এর-ওর বাড়িতে দিনমজুরের কাজ করেন মনির। বছরখানেক কাঠমিস্ত্রির সহকারীও ছিলেন। সাতক্ষীরার নলতার কাঠগোলায় আসবাবের এক দোকানেও কাজ করেছেন। কিন্তু জীর্ণ শরীরে কাজ করতে কষ্ট হয়। ওস্তাদ যা তা বলে। এর মধ্যেই পাশাপাশি লেখাপড়া। এসএসসি পাস করে ঢাকায় একটা ওষুধ কোম্পানিতে শ্রমিকের কাজ নেন। মনিরুল বললেন, ‘নলতা মাজারের এক খাদেম আমাকে পড়ালেখা করতে সহায়তা করেন। তখন ঢাকা থেকে আবার সাতক্ষীরায় চলে আসি। উচ্চমাধ্যমিক পাস করে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হই।’ সেখান থেকে ৩৫তম বিসিএস ক্যাডার মনিরুল। এখন মাদারীপুর সরকারি কলেজের রাষ্ট্রবিজ্ঞানের প্রভাষক।
মনিরুল বলেন, ‘দিনমজুর থেকে আমি বিসিএস ক্যাডার হয়েছি। বলতে কোনো লজ্জা নেই। দিনমজুর, কাঠমিস্ত্রি অথবা বর্গাচাষি কোনো পরিচয় নিয়ে আমার আক্ষেপ নেই। শপথ করে বলছি, সমাজের কাছে হেরে যেতে চাই, এই সমাজটিকেই জেতাব বলে।’ কথা বলতে বলতে মনিরুলের চোখ ভিজে যায় আনন্দে।
ট্রাকের হেলপার থেকে কলেজশিক্ষক
কুড়িগ্রাম সদর উপজেলার পলাশবাড়ীর চৌকিদারপাড়ায় বাড়ি শফিকুলের। বাঁশের চাটাই আর পাটখড়ির বেড়ার জরাজীর্ণ ছোট দুটি ঘর। সেখানেই থাকত শফিকুলের পরিবার। শফিকুলের বাবা ছিলেন বিড়িশ্রমিক। অভাবের কারণে সপ্তম শ্রেণিতেই তাঁর পড়ালেখা বন্ধ হওয়ার জোগাড় হয়। শিক্ষকেরা তখন বিনা বেতনে পড়ার সুযোগ করে দেন। খাতা-কলমসহ অন্যান্য খরচের অভাবে আবারও আটকে যায় তাঁর পড়ালেখা। নানাজনের সহযোগিতায় ২০০৫ সালে এসএসসি পরীক্ষা দেন শফিকুল। মানবিক বিভাগ থেকে জেলায় একমাত্র শিক্ষার্থী হিসেবে জিপিএ-৫ পান।
শফিকুল ইসলাম বলেন, ‘এসএসসির পর অনেকেই বলতেন আর পড়ে কী করবি? এর চেয়ে বরং কোনো কাজ শিখে নে। তাহলে কিছু করে খেতে পারবি। আমারও অবুঝ মন বলত, তাই বুঝি।’
এসব ভেবে এসএসসির পর তিনি কাঠমিস্ত্রির কাজে যুক্ত হন। কিছুদিন জোগালি হিসেবে কাজ করেন। দিনে ৩০ টাকা মজুরি। কিন্তু এতেও পোষাচ্ছিল না। কারণ, এক দিন কাজ জোটে তো অন্য দিন বেকার। পেশা পরিবর্তন করে সাইনবোর্ড–ব্যানার লেখার কাজ নেন। সেটাতেও ঠেকে গেলেন। এরপর হলেন ট্রাকচালকের সহকারী।
শফিকুল বলছিলেন, ‘ট্রাকের হেলপার থাকার সময়েই একদিন শুনতে পেলাম, আজ এসএসসির রেজাল্ট হবে। আমি তখন প্রায় ২০০ কিলোমিটার দূরে, দিনাজপুরে। ফিরতে সন্ধ্যা হবে। মনে মনে খুব শঙ্কা কাজ করছে, এ প্লাস না পেলে পড়াশোনা বন্ধ হবে।’ কুড়িগ্রামে পৌঁছানোর পরই তাঁর এক বন্ধু জানালেন ‘তুই এ প্লাস (জিপিএ-৫) পেয়েছিস।’ অদম্য মেধাবী হিসেবে তখন তাঁর কাহিনি প্রথম আলোয় প্রকাশিত হয়েছিল। অনেকেই এগিয়ে এলেন তাঁকে সহায়তা করতে। ভর্তির সুযোগ পেলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজবিজ্ঞান বিভাগে।
শফিকুল এখন ৩৫তম বিসিএসে শিক্ষা ক্যাডারে উত্তীর্ণ হয়ে লালমনিরহাট সরকারি মজিদা খাতুন কলেজের সমাজবিজ্ঞান বিভাগে শিক্ষক হিসেবে যোগ দিয়েছেন। শফিক বলেন, ‘২ মে চাকরিতে যোগ দিয়েছি। প্রথম বেতনের টাকা দিয়ে বাবা-মায়ের থাকার ঘরটি মেরামতের কাজ করাব। আমি আমার মতো অভাবী শিক্ষার্থীদের জন্য শিক্ষাবৃত্তির ব্যবস্থা করতে চাই। টাকাপয়সার অভাবে কারও পড়ালেখা যেন থমকে না যায়, সেটা নিশ্চিত করতে চাই আমি।’
কৃষিশ্রমিক থেকে এখন প্রভাষক
নেত্রকোনা সদর উপজেলার আমতলা ইউনিয়নের শিবপ্রসাদপুর গ্রামে জন্ম আলামিন খানের। অভাবের কারণে বাবার সঙ্গে পরের জমিতে কৃষিকাজ করতেন। এসএসসি পর্যন্ত সকালে মাঠে গিয়ে গরুর জন্য ঘাস কেটে তারপর স্কুলে যেতেন। পরিবারের আর্থিক অবস্থা এমন যে লেখাপড়া করতে চাওয়া বিলাসিতা। কারণ, দুইবেলা খাওয়া জোটাতেই চলে জীবনের সংগ্রাম। তবে ছেলের লেখাপড়ার প্রতি আগ্রহ দেখে গ্রামের স্কুলে ভর্তি করে দেন তাঁর মা। কিন্তু প্রথম শ্রেণিতেই সবাইকে পেছনে ফেলে বার্ষিক পরীক্ষায় প্রথম হলেন আলামিন। এরপর মা এনজিও থেকে ঋণ করে ছেলের পড়ালেখা চালাতেন।
আলামিন বলেন, ‘আমি দেখলাম প্রথম হলে মা-বাবা খুব খুশি হয়। আমার মধ্যে তখন প্রথম হওয়ার ইচ্ছে তীব্র হলো। ওয়ান থেকে টেন পর্যন্ত প্রতিবার প্রথম হলাম এবং প্রথম হয়েই মা-বাবাকে সালাম করে আনন্দ পেতাম।’
স্কুলে প্রতিবছর সবার পাস করা নিয়ে শিক্ষকেরা যেখানে চিন্তায় থাকতেন, সেখানে আলামিনকে নিয়ে তাঁরা স্বপ্ন দেখতে শুরু করলেন। সারা রাত জেগে লেখাপড়া করেন আলামিন। মা বলেন, ‘বাবা, একটু ঘুমাও।’ তবে লেখাপড়া থামে না আলামিনের। ২০০৪ সালের এসএসসি পরীক্ষায় পুরো কেন্দ্রে শুধু আলামিনই জিপিএ-৫ পেলেন। অন্যরা উচ্চমাধ্যমিকের বই দিল। নেত্রকোনা সরকারি কলেজ থেকে জিপিএ-৫ নিয়ে উচ্চমাধ্যমিক পাস করে ভর্তি হলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজকল্যাণে। তখন আরও তিন ভাইবোন স্কুলে। ছেলের লেখাপড়ার খরচ চালাতে শেষ সম্বল গয়না বিক্রি করে দিলেন তাঁর মা। খবর জেনে প্রচণ্ড কষ্ট লাগে আলামিনের। একটি ব্যাংকের শিক্ষাবৃত্তি দেখে আবেদন করলেন। প্রতি মাসে ১ হাজার ৫০০ টাকা। আর্থিক কষ্টের কারণে বিশ্ববিদ্যালয় জীবনে শুধু সবজি আর ডাল দিয়ে ভাত খেতেন। তবে সারাক্ষণ পড়তেন।
স্নাতকে প্রথম শ্রেণি পেলেন। এরপর বিসিএস দিলেন। ৩৫তম বিসিএসের শিক্ষা ক্যাডারে যোগ দিয়ে প্রভাষক এখন আলামিন।
EmoticonEmoticon