সাতক্ষীরা :একটি সম্ভাবনাময় কিশোর, যে কি না বারংবার সামাজিকভাবে অপমানিত হয়েছে কতিপয় বখাটের দ্বারা, প্রকাশ্যে প্রহৃত হয়েছে তাদের দ্বারা কিন্তু এত প্রতিকূলতা আর মানসিক যন্ত্রণায় মধ্যেও দেয়া এসএসসি পরীক্ষা দিয়ে বায়োলজি ব্যাতীত প্রতিটি বিষয়ে এ প্লাস পেয়ে পাশ করেছে বিজ্ঞান বিভাগে তাকে আত্মহত্যা করতে হয় তখন দোষীদের কি ছেড়ে দেয়া যায়? সাতক্ষীরা শহরে সম্প্রতি ঘটে যাওয়া বহুল আলোচিত এই ঘটনাটি সংবাদপত্রের পাতায় যায়গা পাচ্ছে না, থানায় মামলা হচ্ছে না, তার লিখে যাওয়া ‘সুইসাইড’ নোটসহ অসংখ্য প্রমাণাদি থাকা সত্ত্বেও এখনও পর্যন্ত কোন মামলা পর্যন্ত হয়নি এই মর্মান্তিক মৃত্যুর ঘটনায়। সমস্ত সাতক্ষীরা শহর যেন গুমরে গুমরে কাঁদছে মেধাবী অর্ণবের মর্মান্তিক মৃত্যুতে, ধিক্কার জানাচ্ছে এ মনুষ্যত্বহীন সমাজকে।
২০১৬ সালের এসএসসি পরীক্ষায় সাদিদ ফারজিন অর্ণব ‘এ’ প্লাস পেয়েছে। সাতক্ষীরা সরকারি উচ্চ বিদ্যালয় থেকে অর্ণব বিজ্ঞান বিভাগে উত্তীর্ণ হয়েছে। গত ১১ মে এসএসসি’র ফল প্রকাশিত হয়। কিন্তু ফল প্রকাশের ২ দিন আগে ৯ মে অর্ণব চলে গেছে না ফেরার জগতে। অর্ণবের ‘এ’ প্লাস পাওয়ার কৃতিত্ব তার পিতা-মাতা ও স্বজনদের কোনভাবেই সান্তনা দিতে পারছে না। পিতা-মাতা ও ছোট ভাইকে নিয়ে তোলা একটি ছবি ও অর্ণবের হাতে লেখা একটি ডায়রির কিছু পাতার ফটোকপি এখন শুধু স্মৃতি। গোটা বাড়িতে পাথরের নীরবতা। সে নীরবতা ভেঙে মাঝে মাঝে ডুকরে ডুকরে ভেসে আসছে কান্নার শব্দ।
সাতক্ষীরা শহরের রাজার বাগান এলাকায় অর্ণবদের বাড়ি। তার পিতার নাম মোঃ জিল্লুর রহমান। মাতার নাম মেহেরুন্নেছা। দুই ভাইয়ের মধ্যে অর্ণব বড়। ছোট ভাই জাদিব ফারজিন আবির অষ্টম শ্রেণির ছাত্র।
২০১৬ সালের এসএসসি পরীক্ষায় সাদিদ ফারজিন অর্ণব জিপিএ-৫ পেয়েছে। মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিক শিক্ষা বোর্ড, যশোরের অধীন সাতক্ষীরা সরকারি উচ্চ বিদ্যালয় থেকে অর্ণব বিজ্ঞান শাখা থেকে পরীক্ষায় অংশ নিয়েছিল। কিন্তু নিজের এ সাফল্য দেখে যেতে পারেনি অর্ণব। ফল প্রকাশের ২ দিন আগে (৯ মে) আত্মহত্যার আগে ডায়েরিতে লিখে গেছে, ‘ফজরের নামাজ পড়ে ঝুলে পড়ব।
অর্ণবের জিপিএ-৫ পাওয়ার কৃতিত্ব তার বাবা-মা ও স্বজনদের কোনোভাবেই সান্তনা দিতে পারছে না। বাবা-মা ও ছোট ভাইকে নিয়ে তোলা একটি ছবি ও অর্ণবের হাতে লেখা একটি ডায়রির কিছু পাতার ফটোকপি এখন শুধুই স্মৃতি। গোটা বাড়িতে কবরের নীরবতা। সে নীরবতা ভেঙে মাঝে মাঝে আঁতকে ওঠা কান্নার শব্দ।
অর্ণবের বাবা জিল্লুর রহমান বলেন, ‘অর্ণব পঞ্চম শ্রেণির সমাপনী পরীক্ষায় ট্যালেন্টপুলে বৃত্তি পেয়েছিল। অষ্টম শ্রেণির সমাপনী পরীক্ষায়ও সে ট্যালেন্টপুলে বৃত্তি পায়। ছাত্র হিসেবে অর্ণব ছিল খুবই মেধাবী। সে কবিতা ও ছোট গল্প লিখতো। ডিবেটে অংশ নিয়ে বারবার পুরস্কার নিয়ে ফিরেছে। বাংলার পাশাপাশি ইংরেজিতেও তার পারদর্শীতার প্রশংসা করেন সবাই। অর্ণবের স্বপ্ন ছিলো বুয়েটে লেখাপড়া করে বড় অফিসার হয়ে দেশের সেবা করার। কিন্তু তার সে স্বপ্ন আজ শুধুই স্মৃতি। অর্ণব চলে গেছে না ফেরার জগতে।
অর্ণবদের গ্রামের বাড়ি সাতক্ষীরার কলারোয়া উপজেলার গোপিনাথপুর গ্রামে। বাবা জিল্লুর রহমান একজন ব্যাংকার। তিনি চাকরি করেন অগ্রণী ব্যাংকে। সে কারণে দশ বছর ধরে সাতক্ষীরা শহরের রাজারবাগান সরকারি কলেজের পাশে বসবাস করে আসছেন।
জিল্লুর রহমান জানান, অর্ণব আর ফিরে আসবে না। যাদের কারণে অর্ণব আত্মহত্যা করেছে তাদের আইনের আওতায় এনে বিচারের কাঠগোড়ায় দাঁড় করানোর দাবি জানান তিনি।
অর্ণবের মা মেহেরুন্নেছা জানান, অর্ণব ছিল তাদের আশার বাতিঘর। সে ঘরে আজি অন্ধকার নেমে এসেছে। অর্ণবের সাফল্য ‘এ প্লাস’ তাদের কোনোভাবেই সান্তনা দিতে পারছে না। বারবার অর্ণবের কথা মনে করে ডুকরে কেঁদে উঠছেন তিনি।
কী এমন হলো যে, অর্ণবের মতো একজন মেধাবী ছাত্রকে অকালে অবেলায় পৃথিবী ছাড়তে হলো?
মৃত্যুর আগে অর্ণবের ডায়রিতে লিখে গেছে সে কারণ।
৩ মে লেখা ছয় পৃষ্ঠার ওই চিঠিতে অর্ণব লিখেছে অনেক কিছু। পুলিশ অর্ণবের ব্যবহৃত একটি অ্যানড্রয়েট মোবাইল ফোন ও ডায়রিসহ চিঠিপত্র জব্দ করেছে। চিঠির ফটোকপি ছাড়া আর কিছুই নেই জিল্লুর রহমানের কাছে। চিঠিতে অর্ণব লিখেছে ‘I am sorry শেষ পর্যন্ত আমাকে সত্যিই এই Decision নিতে হল। ডিপ্রেশন আমাকে জীবন্ত লাশই বানিয়ে রেখেছে। এভাবে আর পারছি না। আমি আমার মৃত্যুর কারণ লিখে যাচ্ছি। যদিও আমার ডায়রি যেটা এখন (মেয়ের নাম) কাছে। ওটা থেকে আমার মৃত্যুর কারণ আরও স্পস্ট হবে…।
এরপর অর্ণব তার আব্বু, ছোটভাই আরিবকে উদ্দেশ্য করে স্মৃতিচারণপূর্বক স্বপ্নের কথা লিখেছে। বাবাকে উদ্দেশ্য করে একাংশে লিখেছে ‘তুমি অফিস যাওয়ার আগে সব সময় আমার ঘুম ভাঙিয়ে ডেকে বলে যাও না। কিন্তু আজ তুমি বলে গেলে। Thank you আব্বু। তুমি কেঁদো না….।
মাকে উদ্দেশ্য করে লিখেছে, ‘মাফ করে দিও আমাকে। তোমাদের স্বপ্ন ভেঙে দিয়ে যেতে হচ্ছে আমাকে। আমার নিজেরই তো কোনো স্বপ্ন আর বেঁচে নেই…। আর আমার মা-টা যখন কাঁদে খুব কষ্ট হয় আমার। কেঁদো না আর আম্মু! হয়তো দেখা হবে আবার।
ছোট ভাই আবিরকে উদ্দেশ্যে করে লিখেছে, ‘তোর ড্রয়ার থেকে ২শ টাকা চুরি করেছি। দিতে পারব না…।আম্মুর সাথে ঝগড়া করবি না। খুব মন দিয়ে পড়াশোনা করবি। অন্য কোনো ইচ্ছা হলে আম্মুকে বলবি। একা একা কোনো সিদ্ধান্ত নিতে গেলে কিন্তু আমার মত ফাঁসবি…। আর শোন! নতুন বছরের প্রথম বৃষ্টিতে ভিজবি। বৃষ্টিতে ভিজলে জ্বর হয় না…। প্রথম বৃষ্টিতে ভিজে গোসল করলে সব পাপমুক্তি হয়। এটা তোর ভাই এর Theory।
এরপর মেয়েটির আম্মু-আব্বুকে আঙ্কেল-আন্টি বলে সম্বোধন করে অর্ণব লিখেছে, ‘ও খুব খারাপ কিছু কাজ করেছে। ওকে বুঝায়েন… আর প্রভা আপুকে অনেক থ্যাংকস।
রাহুল নামের একজনকে ভাইয়া সম্বোধন করে অর্ণব লিখেছে, ‘আমি জানি ছয় ছয় বার কেন আপনি আমাকে মেরেছেন। আপনার জায়গায় আমি থাকলেও হয়তো এটাই করতাম। কিন্তু একবারও কি ভেবেছেন এত মানুষের সামনে মার খাওয়ার অভিজ্ঞতা কেমন হতে পারে?
একটি মেয়ের নাম লিখে তাকে উদ্দেশ্য করে লিখেছে, ‘আবার (মেয়েটির নাম) অন্যায় করেছ তুমি।…২০১৩। তোর সাথে আমার ফ্রেন্ডশিপ হল। ২০১৪ এর ১০ ফেব্রুয়ারি আমি তোরে প্রপোজ করলাম। অ্যাকসেপ্ট করলি। খুব সুন্দর দিন কাটছিল। হঠাৎ রমজান মাসের ১ তারিখে রোজা থাকা অবস্থায় ওরা মারলো আমাকে।… তোমরা সবাই মিলে রাস্তার উপর মারলে আমাকে। বাম কানটা গেল। স্কুল ড্রেসের টি-শার্টের বোতামগুলো ছিড়ে দিলে। তোমরা পনেরো বিশজন একটা ছোকরারে মারলে। তোমাদের লজ্জা করল না?…. আমার ফোনের সম নামের ফোল্ডারে সব আছে।….. যা তুমি করছ তা ভালো কাজ না। আমার ২০১৫-১৬ ডায়রি তোমার কাছে। ২০১২-২০১৩-২০১৪ ডায়রি আর তোমার দেয়া লেটারগুলো আমার ঘরে শোকেস এর ড্রয়ারে আছে। এবার বলি যে, আমার একটু ভয় ভয় করছে। ফজরের নামাজ পড়ে ঝুলে পড়ব।…..I Love you All ।
এরপর ৯ মে রাতে দুটি গামছা গিঁট দিয়ে নিজের গলায় পেঁচিয়ে ফ্যানের সঙ্গে বেঁধে ঝুলে পড়ে অর্ণব। সকালে পুলিশ গিয়ে তার ঝুলন্ত লাশ উদ্ধার করে। চিঠিতে পাভেল, মেধা, সাকিবসহ আরো কয়েকজন বন্ধুর কথা উল্লেখ করেছে অর্ণব।
অর্ণবের বাবা জিল্লুর রহমান বলেন, ‘৩ মে রাতে অর্ণব আত্মহত্যার চেষ্টা চালায়। কিন্তু ওর মায়ের হাইপ্রেশারজনিত সমস্যার কারণে সবাই জেগে থাকায় সে সফল হয়নি। ওইদিন সে তার ডায়রি লিখে রাখে। এরপর ৯ মে রাতে অর্ণব সবার অজান্তে ফ্যানের সঙ্গে গলায় গামছা বেঁধে আত্মহত্যা করে।
তিনি আরো বলেন, ‘একটি মেয়েকে ভালোবাসতো। মেয়েটিও অর্ণবকে ভালোবাসতো। এরই মাঝে রাহুল নামে আরেকটি ছেলের সঙ্গে মেয়েটির সম্পর্ক হয়। রাহুল ও তার দলবল অর্ণবকে রাস্তায় ফেলে ছয় ছয় বার মারধর করে। এতে অর্ণবের কান ফেটে রক্ত পড়ে। জামাকাপড় ছিঁড়ে যায়। এতে অর্ণব ইমোশনাল হয়ে পড়ে। এক পর্যায়ে অর্ণব মেয়েটির সাথে একবারের জন্য কথা বলতে পা ধরতে উদ্যত হয়। তার বাসায় চলে যায় অর্ণব। কিন্তু মেয়েটির বাবা তাকে তিরস্কার করায় ফিরে আসে। বিষয়টি কারো সঙ্গে শেয়ার করতে না পেরে বড় একা হয়ে যায় অর্ণব।’
EmoticonEmoticon